Bee ধারাবাহিক উপন্যাসঃ নাইয়র (শেষ পর্ব) Star

লিখেছেন লিখেছেন মামুন ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ১১:৫৫:৪৩ রাত



Roseসেদিন অনেক ভোরে উঠল মোতাহার। সামনে ইলেকশন। দিনভর এদিক সেদিক ছোটাছুটি করতে হচ্ছে। সাথে মুজিবরও থাকে। স্কুলের কাজ পারুল আর অন্যরা সামলে নিচ্ছে।

নিজেদের পারিবারিক কবরস্থান পরিষ্কার করালো মোতাহার নিজে দাঁড়িয়ে থেকে। বেশ জঞ্জাল হয়ে গেছিলো। এখানে ওর দাদা-দাদী এবং বড় চাচা শুয়ে আছেন। কাজ শেষে কবর জিয়ারত করে ঘরের ভিতরে বাইকের চাবি আনতে গেলো।মোবাইলে কথা বলতে বলতে বের হল। ভিতরে বসেই মুজিবরকে আসার জন্য কল দিয়েছিল। সে খালের সামনে বড় রাস্তায় থাকবে জানিয়েছে।

আজ চানকাঠীতে দলীয় প্রচারণায় যেতে হবে। মোতাহার বাজারের ইউপি অফিসে কিছুক্ষণ সময় কাটালো মুজিবরকে নিয়ে। টুকটাক কথাবার্তা আর ওদের প্রোজেক্টগুলোর ব্যাপারে কিছু দিক নির্দেশনা দিলো। এরপর সাড়ে ন'টার দিকে মুজিবরকে পিছনে বসিয়ে চানকাঠীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হল।

রাত দশটার দিকে মোতাহার মুজিবরকে নিয়ে ক্লান্ত দেহে ইউপি অফিসে এসে পৌঁছাল। দুজনে এতোটাই ক্লান্ত যে, বাজার থেকে আর বাড়ির অল্প পথটুকু বাইকে করেও যেতে ইচ্ছে করছিল না। মোতাহার মুজিবরকে ক্ষিধে লেগেছে কিনা জানতে চায়। জবাবে মুজিবর জানায়, একটা আস্ত হাতি সাবাড় করে ফেলতে পারবে এখন। হেসে জলিল এর নাম্বারে ফোন দেয় মোতাহার। বাজারে জলিলের খাবার হোটেল রয়েছে। প্রায় সময়ই মোতাহার রাতে দেরী হলে ওর ওখানে খায়। অবশ্য নিজেকে যেতে হয়নি কখনো। ফোন করলেই নিজের লোক দিয়ে ইউপি অফিসে খাবার পাঠিয়ে দিয়েছে জলিল। ওর নিজের ঘরের খাবারই যে সবসময় মোতাহারের জন্য পাঠায়, অত্যন্ত সযতনে সেই কথাটি এড়িয়ে গিয়েছে।

সাদা ভাত আর কৈ মাছের তরকারির সাথে মুগ ডাল ঘন করে রান্না! দু'জনে বেশ তৃপ্তি করে খেলো। এরপর অফিসের টেলিভিশন ছেড়ে দেশীয় চ্যানেলগুলোতে ঢু মেরে এলো। নির্বাচন পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিটি চ্যানেলেই জমজমাট নিউজ করছে। মনের ভিতর ক্ষীণ একটু আশা ছিল, আজকের ওদের চানকাঠীর নির্বাচনী সভার ব্যাপারে কিছু যদি নিউজে আসে। কেন্দ্রীয় অনেক নেতারাই এসেছিলেন। কিন্তু সেরকম কিছুই দেখালো না।

সাড়া বারোটার দিকে অফিস বন্ধ করে বাইকে করে বাড়ির দিকে রওয়ানা হল। সুন্দর মেঘমুক্ত পরিষ্কার আকাশ। থালার মত গোল চাঁদ রুপালী আলোয় পুরো পথঘাট ভাসিয়ে দিয়েছে। মৃদু বাতাসে গাছের পাতাগুলো ফিসফিস করছে। পুরো প্রকৃতিই যেন কি এক রহস্যের অবগুন্ঠনে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছে। মোতাহার খুব আস্তে বাইক চালিয়ে এগুলো উপভোগ করছিল। সমস্ত রাস্তা সুনসান... নীরব... নিথর। খালের পানির একটানা বয়ে যাওয়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। হরিপদদের বাড়ির সামনের ব্রিজের গোড়ায় এসেই সজোরে ব্রেক কষতে বাধ্য হল মোতাহার। রাস্তা জুড়ে বিরাট এক গাছের গুড়ি পড়ে আছে।

ওরা এসেছিলো দুই মটর সাইকেলে। ব্রীজের ওপারে বাইক রেখে একজন পাহারায় রয়ে গেলো। বাকী তিনজন যেখানে গাছের গুড়ি ফেলা হয়েছে, সেখানে অন্ধকারে রাস্তার দু'পাশে প্রস্তুত হয়েই ছিল। মোতাহার বাইক থেকে নামতেই দু'দিক থেকে তিনজন উন্মুক্ত আগ্নেয়াস্ত্র হাতে চাঁদের আলোয় বেরিয়ে এলো। তিনজনই যুবক। মোতাহারের বয়সীই হবে। ওদেরকে দেখে মোতাহার একটু চমকালেও ভয় পেলো না। শুধু জিজ্ঞেস করতে পারলো, ' কারা তোমরা?'

কোনো কথা না বলে ওরা ওদের হাতের অস্ত্র দিয়ে মোতাহারকে লক্ষ্য করে গুলি করতে লাগলো। এরা যে পেশাদার তা ওদের গুলীবর্ষণেই বোঝা যাচ্ছিল। নির্দিষ্ট পয়েন্টে গুলি করে ওরা মোতাহারকে ঝাঁঝরা করে দিলো। মুজিবর ওদের লক্ষ্য না হলেও সে মোতাহারকে বাঁচাতে সামনে এগিয়ে আসে। এবং গুলি বর্ষণের ভিতরে পড়ে যায়। ওর ফুসফুসের পাশ দিয়ে একটি গুলি পীঠ ভেদ করে বের হয়। ডান হাতে লাগে দু'টি। সেও মোতাহারের পাশেই রাস্তায় পড়ে যায়।

কিলার দলের দু'জন ব্রীজ দিয়ে ওপারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। বাকীজন মোতাহারের কাছে ফিরে আসে। মোতাহার তখনো সজ্ঞান রয়েছে। মাটিতে পড়ে থেকে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগের যে প্রগলভতায় সে মুগ্ধ হয়েছিল, নিমিষে কোথা থেকে যে যন্ত্রণার পাহাড়্গুলো এসে ওকে এভাবে ঘিরে রাখবে- ভাবতেই পারেনি। ওর দৃষ্টির সীমায় ঘাতকের নির্লীপ্ত অবয়ব এসে দাঁড়ায়। চাঁদকে আড়াল করে মোতাহারের অনুভূতিতে আরো কিছু যন্ত্রণা উপহার দিতেই ওর হাতের অস্ত্রটি আরো একবার কেশে উঠে। সাইলেন্সার লাগালো অস্ত্র ব্যবহার করছে এরা। নিজের কপালের মাঝে গুলিটি লাগার আগে মোতাহার অস্ফুটে ঘাতকের উদ্দেশ্যে কিছু একটা বলতে চায়। কিন্তু শুধু ওর ঠোঁটের কোণ একটু কেঁপে উঠে। পরক্ষণেই এক অন্ধকার টানেলের ভিতরে নিজেকে সঁপে দিয়ে ওর সমগ্র অস্তিত্ব অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে।

তৃতীয় কিলার ব্রীজের উপরে থাকাকালীনই খালের দু'পাশ দিয়েই অনেক মানুষের হৈচৈ চীৎকার চেঁচামেচি শোনা যায়। মোতাহার যেখানে পড়ে ছিল, সেখানে এক গ্রুপ এসে তাঁকে চিনতে পেরেই ' আমাদের চেয়ারম্যানরে মাইরা ফালাইছে রে' বলে চীৎকার দেয়। তার চীৎকার শুনেই কোথা থেকে যেন ত্রিশ-চল্লিশজন মানুষ অন্ধকার ফুঁড়ে বের হয়। আর খালের অপর পারেও একই অবস্থা। এই নিশ্চুপ প্রকৃতির মাঝে এতোক্ষণ কোনো মানুষের দেখা মেলেনি। হঠাৎ কোথা থেকে এরা উদয় হল? চারজন কিলার সেই উন্মুক্ত গ্রামবাসীর হাতে গণপিটুনি খাবার সময়ে এটাই ভাবছিল, তাদেরকে যারা ভাড়া করেছে, ব্রীফ করার সময় বলেছিল যে, তারা আশে পাশেই থাকবে। কিন্তু তা যে তাদেরকে একেবারে নিশ্চুপ করানোর জন্য, সে কথা ঘুণাক্ষরেও ওরা একবারও ভাবেনি।

কিছুক্ষণের ভিতরেই পুরো গ্রামবাসী জেনে গেলো এই লোমহর্ষক ঘটনার কথা। পারুল, মোতাহারের বাবা-মা, মুজিবরের বাবা-মা সহ সকলে ঘটনাস্থলে হাজির হয়। এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারনা হল। মোতাহারের লাশের পাশে ওর বাবা-মা বিলাপ করা শুরু করেছে। পারুল ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক হয়ে পড়েছে। কয়েকজন মুজিবরকে পরীক্ষা করে বুঝতে পারে, সে বেঁচে আছে। দ্রুত তাঁকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠানো হল। পারুলও সাথে গেল।

নাজিরপুর থানার পুলিশের একটি টীম ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিজেই এসেছেন। লাশের সুরতহাল পরীক্ষা করার সময়ে ওসি মনোয়ার উপস্থিত লোকজনকে প্রাথমিক জেরা করেন। তাঁদের কাছ থেকেই খালের অপর পাড়ে খুনী চারজনের লাশ পড়ে আছে জানতে পারেন। সেখানে গিয়ে মাটিতে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে পড়ে থাকা চারজনকে দেখে পরীক্ষা করেন। একবার দেখেই বুঝেছেন এরা মারা গেছে। ওদের পাশেই তিনটি অস্ত্র পড়ে আছে। সবগুলোতে সাইলেন্সার লাগানো। নিজের ওয়াকিটকি বের করে থানায় কথা বলেন। আরো একটি টীমকে দ্রুত এখানে আসার নির্দেশ দিলেন।

মুজিবরকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পরে কর্তব্যরত ডাক্তার পরীক্ষা করে অবস্থা খুব ক্রিটিক্যাল জানান। এক্ষুনি জেলা সদরে নেবার কথা বলেন। পারুল এবং মুজিবরের বাবা-মা একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে মুজিবরকে নিয়ে পিরোজপুরের দিকে রওয়ানা হয়।

পরের দিন... নাজিরপুর থানা।

ডিউটি অফিসারের সামনে হাবিব মুন্সী এবং মালেক শিকদার বসে আছেন। হাবিব মুন্সী খুবই মর্মাহত, তাঁকে দেখেই সবার এমনটাই মনে হবে। মালেক শিকদার ভাবলেশহীন। এখানে আসার মূল উদ্দেশ্য হল, মোতাহার মার্ডার কেস সম্পর্কে জানা। কিন্তু বাহিরে তাঁরা বুঝাতে চাইছেন অন্য কিছু। মোতাহারের বাবা ঢুকলেন কিছুক্ষণ পরে। হাবিব মুন্সীর দিকে তাকালেনই না।ওসির রুমে চলে গেলেন। মোতাহারের লাশ মর্গ থেকে কখন আসবে জানতে চাইলেন। আর লাশ নেবার অন্য কোনো ফর্মালিটি রয়েছে কিনা তাও জানলেন। ওসি খুব বিনীতভাবে তাঁকে বসালেন। বললেন চিন্তা না করতে। পিরোজপুর থেকে লাশ এলেই তাঁকে থানায় খবর দেয়া হবে। ওসি মনোয়ার মোতাহারের বাবা চলে যেতেই নিজের সামনে হাবিব মুন্সী এবং মালেক শিকদারকে ডেকে পাঠালেন।

ওনারা দুজন ওসির সামনে বসতেই তিনি বললেন, ' ছেলেটাকে মেরেই ফেললেন?' মালেক শিকদার চমকে গেলেও হাবিব মুন্সী নীরব রইলেন। শুধু ঠান্ডা স্বরে বললেন, ' কথা বার্তা ঠিক করে বইলেন। কি বলছেন বুঝতে পারছেন?'

ওসি উত্তরে হাসলেন। অনেক্ষন শব্দহীন সেই হাসি ওদের দু'জনের শরীরকে জ্বালিয়ে দিয়ে গেলো। কিন্তু ওনারা চুপচাপ সেই ব্যঙ্গটুকু সহ্য করতে বাধ্য হলেন। ওসি থামলে হাবিব মুন্সী জিজ্ঞেস করেন, ' এই খুনীদের কি চিনতে পেরেছেন?'

- হ্যা।

' এরা কোন দলের সাপোর্টার?'

- এদের কোনো নির্দিষ্ট দল নেই। যারা টাকা দেয় তাদেরই ভাড়া খাটে এরা। তবে আপনাদের বিপক্ষের দলটির সাথে এরা প্রকাশ্যে মেলা মেশা করে আসছে, মানে এরা সীন পলিটিক্স করে ঐ দলের।' মালেক শিকদারকে লক্ষ্য করে কথাগুলো বললেন ওসি মনোয়ার।

মালেক শিকদার বললেন, ' আমাদের বিপক্ষে তো দুইটি দলই রয়েছে, আপনি কোন দলের কথা বলতে চাইছেন?'

- আপনারা যদি স্বাধীনতার পক্ষে হন, তবে সরাসরি বিরোধীতা যারা করেছিল তাদের।

ওসির কথা শুনে হাবিব মুন্সী এবং মালেক শিকদার চুপ করে থাকেন। তবে কিছুটা খুশী যে হয়েছেন, তা বোঝা যায়। তবে ওসির পরবর্তী কথায় আবারো চমকে যেতে হয় ওনাদের দুজনকে।

- খুব সুন্দর সাজিয়েছেন ঘটনাটা। মোতাহার আপনাদের দলের লোক। তাকে মারালেন বিরোধী দলের ক্যাডারদের দ্বারা। সামনে ইলেকশন... এক ঢিলে দু' পাখি মারলেন। তবে চালে একটু ভুল করে ফেলেছেন...

মালেক শিকদার ফস করে বলে বসলেন, ' কেমন?' হাবিব মুন্সী রাগত স্বরে মালেক শিকদারের দিকে চাইলেন শুধু। ওসি মনোয়ার সেটা লক্ষ্য করে বললেন,

- আপনাদের এতোগুলো লোক এতো রাতে ঘটনাস্থলে কি করছিলো? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে কয়েকজনকে থানায় নিয়ে এসেছি। পেটে কিছু পড়লেই ওদের মুখও খুলে যাবে।

ওসির কথায় মালেক শিকদারের মুখ শুকিয়ে গেলো। সে একটা ঢোক গিললো। তবে হাবিব মুন্সী ওসিকে বললেন, 'আপনি কিছুই প্রমাণ করতে পারবেন না। চেষ্টা করে দেখেন, শুধু শুধু নিজেকে সমস্যায় ফেলবেন।'

ওসি ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলেন, ' আপনি কি আমাকে ভয় দেখালেন?'

' না, আপনাকে বাস্তবতা টুকুন জানালাম মাত্র। আপনি আর আধা ঘন্টার ভিতরেই, যাদেরকে ধরে এনেছেন, তাঁদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হবেন। আর কিছু লোকের নাম আপনার কাছে আসবে, তাদেরকে এই মামলায় ঢুকাতে বাধ্য হবেন।'- হাবিব মুন্সী উত্তর দেয়।

- আপনি ভবিষ্যৎ বলতে পারেন মনে হচ্ছে? ওসি মন্তব্য করেন।

' না, আমি গোনাহগার মানুষ। আমি পারি না।'

দুজনে দুজনের দিকে দীর্ঘক্ষণ চেয়ে থাকেন। কারো চোখের পলক পড়ে না।

হাবিব মুন্সী এবং মালেক শিকদার বেরিয়ে গেলে নিস্ফল আক্রোশে ওসি মনোয়ার টেবিলের উপরে ঘুষি মারে। শব্দ পেয়ে সেকেন্ড অফিসার ছুটে আসেন। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে সে। নিজেকে সামলে নিয়ে ওসি মনোয়ার বলে, 'আমরা খারাপ এটা সবাই জানে। কিন্তু আমাদের এই খাকি পোষাকের নিচেও যে একটা মানুষের হৃদয় রয়েছে, এটা কেউ মানতে চায় না কেন?' সেকেন্ড অফিসার মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ওসি বলে যেতে থাকে, ' আমরা এই মুন্সীর সাথে ধান্ধাবাজিতে থেকেছি, ঠিক আছে, সেখানে টাকার ব্যাপার ছিল, টাকা সবারই লাগে। কিন্তু যে মানুষটাকে ওরা মেরে ফেললো, সে একজন সত্যিকারের সাদা মনের মানুষ ছিল। ওর ভিতরে আমি আমার যুবক বয়সের 'আমাকে' দেখতে পেয়েছিলাম। চাকরিতে ঢুকবার আগে আমিও মোতাহারের মত সব কিছু ওর দৃষ্টিতে দেখতে চেষ্টা করতাম।'

ওসির মোবাইল বেজে উঠলো। সে রিসিভ করে চুপচাপ ওপাশের কথা শুনতে থাকে। মাঝে মাঝে ' স্যার,'... 'ঠিক আছে' ... 'কিন্তু স্যার'... বলে যেতে থাকে। দশ মিনিট ধরে ওসি মনোয়ার ওপাশের কথা শুনে গেলো। এরপর কথা শেষ হলে সেকেন্ড অফিসারের দিকে তাকিয়ে থাকে অল্প সময়। এরপর হাতের মোবাইলটা দেয়ালের দিকে ছুড়ে ফেলতেই সেটি ভেঙ্গে কয়েক টুকরো হয়ে আলাদা হয়ে মেঝেতে পড়ে থাকে। সেকেন্ড অফিসার অবাক হয়, কিন্তু কিছু বলে না সে।

' যাদেরকে ধরে এনেছ, ওদের সবাইকে ছেড়ে দাও'। ওসি ক্লান্ত স্বরে সেকেন্ড অফিসারকে জানান।

- কিন্তু স্যার...

' তোমাকে যা করতে বলেছি, চুপচাপ তাই কর। আর এই মামলার ব্যাপারে ডিটেইলস আমার কাছ থেকে শুনে সন্তোষকে লিখতে বলবে।'

- ওকে স্যার। সেকেন্ড অফিসার বের হয়ে যেতেই প্রচণ্ড ক্রোধে ওসি মনোয়ার প্রচণ্ড খারাপ ভাষায় একটি গালি দেয়। কিন্তু যাকে উদ্দেশ্য করে দেয়, তার কানে সেই গুঞ্জন মোটেও পৌঁছায় না। একজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার অফিসকক্ষে সেই অশ্রুতিকর শব্দটি কিছুক্ষণ চারদেয়ালে বাড়ি খেয়ে অবশেষে মিলিয়ে যায়।

পিরোজপুর সদর হাসপাতাল থেকে মুজিবরকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। গুলি ভিতরে না থাকাতে ড্রেসিং করে দেয়া হয়। তবে আঘাতের আকস্মিকতায় শকড হবার কারনে এবং অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে সে বেশ দুর্বল হয়ে পড়াতে জ্ঞান ফিরতে অনেক দেরী হচ্ছে। পারুল সারা রাত রুমের বাইরে অপেক্ষা করে। সেই রাতটি পারুলের জীবনের সব চেয়ে দীর্ঘতম রাত ছিল। দরোজার বাইরে নির্ঘুম কাটায় সে। মাঝে মাঝে কাঁচের ফাঁক দিয়ে মুজিবরকে দেখে আসে। আর বসে থাকার সময় মোতাহারের করুণ পরিণতির কথা ভেবে ওর চোখ দিয়ে পানি বয়ে যেতে থাকে। ওকে ঘিরে যে দুজন যুবক ভালোলাগার আবর্তে ঘুরতে চেয়েছিল, আজ তাঁদের এই অবস্থা পারুলকে ব্যথাতুর করে তোলে। নিজের হৃদয়ে এক অবর্ণনীয় কষ্ট থেকে থেকে ওকে তোলপাড় করে যায়।

মোতাহার মার্ডারের পরের দিন দুপুর না গড়াতেই পুলিশ প্রশাসনের বেশ তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়। থানায় পুলিশ বাদী মামলা হয়। সেখানে মৃত চারজন খুনীর সাথে আরো বেশ কয়েকজন মানুষকে জড়ানো হয়। এদের ভিতরে সাম্প্রদায়িক দলের রাজনীতি করেন এমন কয়েকজন জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ের নেতা-কর্মীও রয়েছেন। আর সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হল, মোতাহারের সব সময়ের সঙ্গী, গুলিবিদ্ধ মুজিবরের নামও একেবারে শেষে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে এটা কেন করা হয়েছে, সবার মনে প্রশ্ন জাগলেও, ওসি মনোয়ার বেশ ভালোই জানে। সে জানে বিধায়ই পারুলের মোবাইলে ফোন করে পিরোজপুর থেকে মুজিবরকে অন্য কোনো যায়গায় দ্রুত নিয়ে গিয়ে কিছুদিন আত্মগোপনে থাকার অনুরোধ করে। পারুলের বাবাও তখন ওসির পাশে ছিলেন। সেই অনুযায়ী পারুল মুজিবরকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়।

... ... ...

আরো দু'টি সপ্তাহ কেটে যায়।

শ্রীরামকাঠী গ্রামের জীবনযাত্রা অতি-অস্বাভাবিক অবস্থা থেকে স্বাভাবিক পর্যায়ে আসতে থাকে। সবার ভিতরে এখনো কেমন এক আতংক বিরাজ করছে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না যেন। দুষ্ট চক্র তাদের ভুতপুর্ব প্রভাব নিয়ে স্ব শরীরে হাজির হয়েছে।

একদিন পারুলের মোবাইলে ফোন আসে। ওর মায়ের ফোন। তিনি জানান, এখনো অবস্থা আগের মতই রয়েছে। তবে চার্জশীট থেকে মুজিবরের নাম কাটানোর চেষ্টা চলছে। ওসি সাহেব তার সাধ্যমত করে যাচ্ছেন।

পারুল আরো জানতে পারলো, একই রাতে কলতান কিন্ডারগার্টেন এবং গোলাঘর কারা যেন আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে।

শুনে খুব কষ্ট পায় পারুল। একবার ওর মনে জাগে, গ্রামবাসী করছেটা কি? ওরা কেন প্রতিবাদ করছে না?

পরক্ষণেই নিজের ভুল বুঝতে পারে সে। আসলে সাধারণ জনগনের কাউকে সামনে রেখে আগাতে আগাতে অভ্যাস হয়ে গেছে। তাই ওদের তিনজনকে ছাড়া তাঁরা খুবই অসহায় এখন।

জানালা দিয়ে বাইরের আকাশকে দেখে পারুল। নিজের চোখ দিয়ে বন্যার মত পানি দু'গাল ভিজিয়ে দিয়ে নিচের দিকে নেমে চলেছে। ওর সমগ্র সত্তায় এই মুহুর্তে একটি ছবির মত গ্রাম বিরাজ করছে... সেখানে কিছু সহজ সরল মানুষ... মুষ্টিমেয় দুষ্টচক্রের কুটিল ব্রেইনের দ্বারা নিষ্পেষিত হচ্ছে।

সেই কচিকাঁচাদের স্কুলটি এখন স্থবির হয়ে পড়ে আছে। গ্রামের ছেলেরা আবারো পড়ালেখা ছেড়ে কেউ দোকানে বসবে, পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াবে... আর মেয়েদেরকে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে মা-বাবা নিশ্চিন্ত হতে চাইবে।

আর বসবে না বয়স্ক শিক্ষালয়ের সেই মধুর আড্ডা। যে ক'জন কিছুটা শিখে নিয়েছে, তারাও আবারো কালের গহ্বরে মূর্খতার শিকলে বন্দী হবে।

হয়তো কৃষি ব্যাংকটিও গ্রাহকের অভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। কোব্বাত মিয়ার সুদের ব্যবসা আবারো জমজমাট হয়ে উঠবে।

আর ভাবতে পারে না পারুল। প্রচন্ড একটা কষ্টে ওর দম বন্ধ হয়ে আসে। ডুকরে কেঁদে উঠে সে। এমন সময় কাঁধে কারো স্পর্শ পায় পারুল। পেছনে ফিরে তাকায়। মুজিবর পাশে এসেছে। দুজনের চোখে চোখে কথা হয়। নিরবে সম্মতি দেয় মুজিবর।

যেন সে বলতে চায়, ' হ্যা, অপেক্ষা কর। আমাদেরও দিন আসবে। আবারো আমরা শুন্য থেকে শুরু করবো।'

পারুলও হাতের উল্টো পীঠ দিয়ে চোখের জল মুছে ফেলে। নিজে নিজে ভাবে, ' হ্যাঁ, আমাদের নিজ হাতে বানানো সৌধ এখন ধ্বংস স্তুপ। সেই ধ্বংস স্তুপকেই আবা্রো আমরা নতুন ভাবে গড়বার কাজে ফিরে যাবো। সব তো আমাদের জানাই। কেবল সঠিক সময়ে পুরনো কাজগুলোই নতুন ভাবে শুরু করতে হবে।'

কবি মুজিবরের হাতকে দৃঢ় ভাবে ধরে থাকে পারুল।

একে সাথে নিয়েই আরো একবার পারুলকে নাইয়র যেতে হবে।

কখনোই কোনো শুভ চিন্তার অধিকারী হৃদয়ের মৃত্যু হয় না। কেবলি হৃদয়ের রুপান্তর হয়ে থাকে। বিপ্লব কখনো কারো মৃত্যুতে শেষ হয়ে যায় না। সাময়িক থমকে যেতে পারে। তবে কেউ না কেউ আগের জনের যায়গা নিয়ে নিবেই, তাতে কোনও সন্দেহ নাই।

পারুল এবং মুজিবরের মত মানুষের হৃদয় কখনো খালি থাকে না। ওদের হৃদয়টা দুমড়ে মুচড়ে গেলেও, সেটি প্যান্ডোরার বাক্সের মতই। একেবারে খালি কখনোই হয় না। একটু হলেও আশা থেকেই যায়।

আর আশাই তো প্রচন্ড শক্তিধর।

আবারো এক মেয়ে তার মায়ের কাছে নাইয়র যাবার আশায় নিজেকে প্রস্তুত করে।

এরপর আর কখনো হয়তো তাঁকে নাইয়র যেতে হবে না।। Rose Rose Good Luck

(শেষ)

বিষয়: সাহিত্য

৯২৩ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

264147
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০১:১৩
নিউজ ওয়াচ লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০১:৩১
207654
মামুন লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ।Happy Good Luck
264153
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০১:৩৭
নুর আয়শা আব্দুর রহিম লিখেছেন : লেখালেখিতে আপনি অনেক সময় দেন! আপনার লেখা ভালো লাগে। ধন্যবাদ।
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০২:০৯
207658
মামুন লিখেছেন : ধন্যবাদ আপনাকে/আপনাদের দুজনকে।
অনেক শুভেচ্ছা রইলো।Happy Good Luck
264154
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০১:৪০
নুর আয়শা আব্দুর রহিম লিখেছেন : ফেসবুক আইডি দিন যদি কিছুি মনে না করেন।
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০২:২৫
207664
মামুন লিখেছেন : আমি ফেসবুক থেকে নিজেকে গুটিয়ে আনছি। আপনার (আব্দুর রহিম ভাই) ফেসবুক আইডিটি দিন, আমি রিকোয়েষ্ট পাঠাচ্ছি।
ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা।Happy Good Luck
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০২:৩৮
207665
নুর আয়শা আব্দুর রহিম লিখেছেন : rahim৮৪ এখানে পাঠাতে পারেন
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০২:৩৯
207666
নুর আয়শা আব্দুর রহিম লিখেছেন : ফেসবুকে আমরা https://m.facebook.com/profile.php?id=532296170233750
264162
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০২:০৭
বৃত্তের বাইরে লিখেছেন : পারুল এবং মুজিবরের মত সংগ্রামী মানুষদের আশা,আকাঙ্ক্ষা,স্বপ্নগুলো কুয়াশা ঢাকা অসীম সাগরে দিশাহীন নাবিকের মত যারা একবিন্দু আলোর আশায় চেয়ে থাকে বাতিঘরের দিকে। শিল্পী-সাহিত্যিকের কাজই তাদের সেই আবেগ, অনুভূতিকে উপলব্ধি করতে পারা। সমাজের নানা অসংগতি,কুসংস্কার, সামাজিক বাঁধাগুলো অসাধারন লেখনী দিয়ে তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ ভাইয়া আপনাকে Happy আশা করি আগামীতে আরও লিখবেন Good Luck Rose Good Luck
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০২:২৩
207663
মামুন লিখেছেন : এই লেখাটি নিয়ে আমাকে অনেক বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। ফেসবুকের একটু গ্রুপে এর একটি পর্ব নিয়ে অহেতুক বিরোধে জড়িয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত সেই গ্রুপটিকে 'লীভ' করেছি। তাই মনের কোথায় যেন একটু দ্বিধা রয়েই গেল। শেষটা 'শেষের মত' হল না।
আপনাকে ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যের জন্য। 'রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র' নিয়ে কয়েক পর্বের একটি বড় গল্প ইনশা আল্লাহ একটু ঘসা-মাজা করে আগামিকাল থেকে পোষ্ট করা শুরু করব। এটি আগে লিখেছিলাম।
ভালো থাকবেন। অনেক শুভেচ্ছা।Happy Good Luck
264174
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০৪:৩২
কাহাফ লিখেছেন : "কখনই শুভ চিন্তার অধিকারী হ্রদয়ের মৃত্যু হয়না।কেবলি হ্রদয়ের রুপান্তর হয়ে থাকে।সাময়িক ভাবে কখনো থমকে গেকেও বিপ্লব কারো মৃত্যুতে শেষ হয়ে যায় না।"
আজ আর কোন মন্তব্য নয়,শুধুই আশা জাগানিয়া স্বপ্নের জাল বোনে যাওয়া। সুস্হ্য-সুন্দর-সাফল্যমন্ডিত জীবন কামনা আপনাদের জন্যে.......... Rose Rose Rose
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ০৯:৪০
207711
মামুন লিখেছেন : আপনার জন্যও সুন্দর-সাফল্যমন্ডিত জীবন কামনা করছি।
জাজাকাল্লাহু খাইর।Happy Good Luck
264308
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০৮:৩৩
আবু সাইফ লিখেছেন :
পিরোজপুর সদর হাসপাতাল থেকে মোতাহারকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।


মাঝে মাঝে কাঁচের ফাঁক দিয়ে মুজিবরকে দেখে আসে।




শেষ পর্যন্তই পড়লাম - হাত ভালো আপনার!

সমাজের আরো গভীরে যেতে চেষ্টা করুন- আরো ভালো হবে!

গল্পের বিস্তৃতির চেয়ে সমস্যার বিশ্লেষণ বেশী প্রয়োজন!

দোয়া করি Praying Praying Praying
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০৯:০৩
207841
মামুন লিখেছেন : আপনার দোয়া আমার সামনের পথের অনুপ্রেরনা হয়ে উঠবে ইনশা আল্লাহ।
চেষ্টা করব আরো গভীরে যাবার।
অনেক ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।
আর ভুলটি এডিট করে দিচ্ছি। আবারো ধন্যবাদ।Happy Good Luck
শুভেচ্ছা রইলো।Happy Good Luck

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File